অভিজ্ঞতা বিনিময় সম্ভাবনা বাড়ায় : মার্ক জাকারবার্গ


অভিজ্ঞতা বিনিময় সম্ভাবনা বাড়ায় : মার্ক জাকারবার্গ!

ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ১৯৮৪ সালের ১৪ মে। তিনি মাত্র ২০ বছর বয়সে চালু করেন সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুক। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও তিনি লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি। ফোর্বস সাময়িকী ঘোষিত ৩০-এর কম বয়সী সফল ব্যক্তিদের তালিকায় রয়েছে (২০১১) জাকারবার্গের নাম।

ফেসবুক নিয়ে আসলে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীকে আরও উন্মুক্ত, আরও সংযুক্ত করা। ব্যাপারটা এমন, যখন মানুষ তার কাছের সব মানুষের সঙ্গে যুক্ত থাকে আর পুরো প্রক্রিয়াটা এমনভাবে দাঁড় করানো হয় যে তারা নিজেদের মনের সব কথা, নতুন চিন্তাচেতনা তার চোখে প্রিয় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে। ফলে অসংখ্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যায়। মানুষ নতুন জিনিস শিখবে, তার চারপাশে ঘটে যাওয়া নতুন ঘটনা, নতুন প্রযুক্তি, নতুন গান, সিনেমা—সবকিছু নিয়েই ভাববিনিময় হবে। মানুষ যখন একে অন্যের সঙ্গে তথ্য ভাগাভাগি করবে, তখন একটা বিশাল সম্ভাবনার সূচনা হবে। তাই আমাদের ফেসবুক মিশনের একটা বড় অংশ ছিল কীভাবে আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের মানুষকে সংযুক্ত করতে পারি। এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয় যে ৮০ কোটির বেশি মানুষ এখন ফেসবুক ব্যবহার করছে। প্রতি মাসেই এ সংখ্যা বাড়ছে। যদি সাত বছর আগের কথা চিন্তা করেন, যখন আমরা শুরু করেছিলাম—তখন আজকের এই অবস্থান আমরা কল্পনাও করতে পারিনি।

মজার বিষয় হলো, আমি যখন কলেজে ছিলাম, আমরা বন্ধুরা মিলে এসব নিয়েই কথা বলতাম। আমরা প্রতি রাতে পিৎজা খেতে যেতাম আর আমাদের চারপাশে ঘটতে থাকা বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতাম। ইন্টারনেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতাম। আমরা ভাবতাম, ভবিষ্যতে হয়তো এমন কিছু একটা আসবে, যেটা দিয়ে মানুষ তার কাছের মানুষের সঙ্গে সহজেই ভাববিনিময় করতে পারবে, যেটা একটা সামাজিক নেটওয়ার্কের মতো হবে। আমরা ভাবতাম, এ রকম নেটওয়ার্ক বানানোর জন্য নতুন কোনো প্রযুক্তি আসবে। আশ্চর্যের কথা হলো, আমরা নিজেরাই সেই সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরিতে বিশাল অবদান রাখতে পেরেছি।

সব মানুষেরই নিজেকে প্রকাশ করার একটা অন্তর্নিহিত ইচ্ছা থাকে। সব সময়ই। এটা মানুষের একটা অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই বলা চলে। আপনার বন্ধু বা কাছের মানুষদের জীবনে কী ঘটছে বা আপনার প্রিয় মানুষটির চারপাশের বিষয়গুলো আপনি নিশ্চয়ই গুরুত্ব দেন, তাই না? যেসব মানুষ সম্পর্কে আপনি আগ্রহ দেখান বা যাঁদের নিয়ে দেখান না, সবাই কোনো না কোনোভাবে আপনার সামাজিক বৃত্তে আবদ্ধ। ফেসবুক আসার আগে আপনি তাঁদের সম্পর্কে খুব বেশি একটা কিছু জানতেন না। ভেবে দেখুন, গত পাঁচ বছরে সামাজিক যোগাযোগ কতটা সহজ হয়েছে। এখন আপনি দ্রুত বুঝতে পারছেন কোন জিনিসটা জানা জরুরি। নতুন গান, নতুন ভালো সিনেমা দেখতে পারছেন; আপনার বন্ধুরা কী দেখেন সেটাও জানতে পারছেন। সব মিলিয়ে আপনার নিজের জীবনযাপনের ধরনই পাল্টে যাচ্ছে। এই সেবাগুলো সামনের দিনগুলোতে আরও পাল্টে যাবে, পাঁচ বছর পরে এই সেবার কতটা উন্নতি হবে, সেটা ভাবতেই আমি শিহরিত হই।

আমি মনে করি, মানুষের সামাজিক সম্পর্কের ব্যাপারটি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্নতর। এখানে কোনো নির্দিষ্ট একটি সংখ্যা বলা যায় না। আমরা আমাদের ফিচারগুলো এমনভাবে তৈরি করছি, যাতে আপনি যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান, সেই ছোট ছোট গ্রুপের সঙ্গে আপনি যোগাযোগ রাখতে পারেন। ৩০ থেকে ৪০ কোটি মানুষ তাদের কিছু বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য প্রতি মাসে অন্তত একবারের জন্য হলেও ফেসবুক ব্যবহার করে। আর পাশাপাশি নির্দিষ্ট কিছু বিষয় সবার সঙ্গে শেয়ার করার মতো উপায়ও এখন আমরা দিচ্ছি। আমরা চেষ্টা করছি সব ধরনের প্রয়োজন মেটাতে। আমার অনেক বন্ধুর ছোট ভাইবোন এখন হাইস্কুল অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তাদের জন্য আমার প্রথম পরামর্শ হলো, প্রোগ্রামিং শেখার চেষ্টা করো। আমার মনে হয়, ভবিষ্যতে শুধু প্রকৌশলীদেরই নয়, প্রায় সব পেশাতেই কিছু না কিছু প্রোগ্রামিংয়ের জ্ঞান দরকার হবে। আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখন একজন কম্পিউটার প্রকৌশলীর বেতন যা ছিল, তা এখন ৫০ শতাংশেরও বেশি বেড়ে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণও হয়েছে। অর্থনীতির ধরন বদলে যাচ্ছে আর প্রযুক্তি এবং সফটওয়্যারভিত্তিক কোম্পানিগুলোই সবচেয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।

ফেসবুক শুরুর গল্পের দুটো ব্যাপার উল্লেখ করার মতো। এটা নিয়ে আমার বড়সড় কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আমার টাকা-পয়সাও তেমন ছিল না। আমি আক্ষরিক অর্থেই আমার ডরমিটরির রুমে বসে ফেসবুকের কোড লিখেছিলাম। ওখান থেকেই যাত্রা শুরু করেছিল ফেসবুক। মাত্র ৮৫ ডলারে আমি সার্ভার ভাড়া নিয়েছিলাম আর সে ভাড়াও দিতাম একটা বিজ্ঞাপন থেকে। পুরো ব্যাপারটারই শুরু খুব ছোট্ট একটা চিন্তা থেকে। তারপর আস্তে আস্তে সেটা বড় হয়ে উঠেছে। তাই আমি বলব, দুটো জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, দক্ষ প্রকৌশলী তৈরি করা, যাঁরা নিজেদের ভাবনাগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে পারবেন। আর দ্বিতীয়ত, সেই চিন্তাগুলোকে রূপ দেওয়ার জন্য তাঁদের যথেষ্ট স্বাধীনতা দেওয়া। ঐতিহ্যগতভাবেই যুক্তরাষ্ট্র এ দুটো দিকেই খুব ভালো। এ দেশ শিক্ষাক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং নতুন কিছু করার ঝুঁকি নিতে উৎসাহ ও স্বাধীনতা দিয়েছে।

আপনি কি এভাবে চিন্তা করেছেন, আপনি প্রতিদিন যা যা করেন, সব কাজের মধ্যে কোন কোন কাজ আরও আনন্দ নিয়ে, ভালোভাবে করা যায়, যখন আপনি সেগুলো অন্য কাউকে সঙ্গে নিয়ে করেন? নিশ্চয় সব নয়, কিন্তু অনেকগুলোই করেন। আমরা মনে করি, ঠিক এই জায়গাটাতেই ফেসবুক ভূমিকা রাখতে পারে। এটা এমন একটা জায়গা, যেখানে আপনি আপনার চারপাশের বন্ধুরা কে কী করছে তা দেখতে পারেন। আমরা ফেসবুককে এভাবেই গড়ে তুলছি।

ফেসবুকের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, আমরা গ্রাহকদের ব্যাপারে সেই তথ্যগুলোই জানি, যা তাঁরা জানাতে চান। বেশির ভাগ মানুষই নিজের সবকিছু শেয়ার করতে চান না, কিন্তু তাঁদের হাতে যদি সেই নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয় যে তাঁরা শুধু তাঁদের বন্ধুদের সঙ্গে, অথবা পরিবারের সঙ্গে, অথবা খুব সুনির্দিষ্ট কিছু মানুষের সঙ্গে শেয়ার করতে পারবেন, তবে তাঁরা সেটাই করেন।

মানুষের শেখার একটি নির্দিষ্ট ধারা আছে। যখন সামাজিক যোগাযোগ প্রথম শুরু হলো, কিছু মানুষ খুব অল্প তথ্য অনেক বিস্তৃত আকারে প্রচার করত। আমি মনে করি, ফেসবুকের জনপ্রিয়তার এটাও একটা কারণ। ফেসবুকের ‘প্রাইভেসি অপশন’ এখন সবাই ব্যবহার করছে এবং ফেসবুকই প্রথম কোম্পানি, যারা এ ধরনের প্রাইভেসি চালু করেছে, যাতে কিছু বিষয় আপনি শুধু বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন অথবা আপনার ছুটির ছবিগুলো শুধু আপনার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন।

ফেসবুক ব্যবহারকারীদের আচরণও কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে। আমরা হার্ভার্ডে ছোট পরিসরে যেটা শুরু করেছিলাম, সেটাই এখন ৮০ কোটিরও বেশি মানুষ ব্যবহার করছে। এর মধ্যে এমন অনেকে আছেন, যাঁরা কম্পিউটারে শুধুই ফেসবুক ব্যবহার করেন, কম্পিউটার চালনায় তাঁরা খুব দক্ষ নন। এ ধরনের মানুষের পক্ষে ঘাঁটাঘাঁটি করে প্রাইভেসি কন্ট্রোলের পদ্ধতি বোঝাটা বেশ কঠিন। তাই আমরা কয়েক বছর ধরে এটাকে এমনভাবে সাজিয়েছি, যাতে আপনি যা-ই শেয়ার করুন তার প্রাইভেসি সঙ্গে সঙ্গে ওখানেই ঠিক করে দেওয়া যায়। আপনি যদি এটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেন, তাহলে সেখানে একটি গ্লোব আসে, যাতে ‘পাবলিক’ কথাটি লেখা থাকে এবং আপনি যদি অল্প কয়েকজনের সঙ্গে শেয়ার করেন, তাহলে সেটিতে ‘ফ্রেন্ডস’ কথাটি লেখা থাকে। এবং মাত্র একটি ক্লিকেই আপনি এই অপশনটি যেকোনো পোস্টের জন্য যেকোনো সময় পরিবর্তন করতে পারেন।

আমি মনে করি, কাজ করা এবং শেখার বেলায় আপনি যত বেশি মানুষের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নিতে পারবেন, আপনার শেখার মাত্রাও তত বাড়বে। আমার মনে হয়, এটাই সব সময় সত্যি। আমি ফেসবুককে সচল রাখার জন্য সবকিছুই করি আর নিজের জীবনযাপনকে যতটা সম্ভব সাধারণ রাখি। ৭ নভেম্বর ২০১১ চার্লি রোজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের সংক্ষিপ্ত ভাষ্য।

No comments

আপনার মুল্যবান মন্তব্য এখানে লিখতে পারেন। ধন্যবাদ।

Theme images by Storman. Powered by Blogger.