শ্রেষ্ঠ মানুষ



একটি ইদুর গুটি গুটি পায়ে আমার বালিসের পাশে রাখা বইয়ের উপর বসে মায়া জড়ানো কন্ঠে বলল, গুড আফটারনুন। কেমন আছিস?

_আমি ওর কথার কোন উত্তর দিলামনা।

_আমাকে কি তুই চিনতে পারছিস?

_আমি এবারো কিছু বললাম না।

ইদুরটির কন্ঠ আফজাল স্যার এর গলার মত লাগছে। আফজাল স্যার আমাদের গণিত ক্লাস নিত। তাকে সবাই প্রচন্ড ভয় পেত। যাকে বলে হিসু করা টাইপ ভয়। স্কচটেপ প্যাচানো একসাথে করা তিনটা বেত নিয়ে তিনি ক্লাসে আসতেন। সেই কারুকার্য বেত দেখে কবির প্রতিদিন হিসু করে দিত। আফজাল স্যার বছর পাঁচেক আগে ভয়ংকর ডায়রিয়ায় মারা গেছেন। অনেকেই বলত, কলেরা লাগছে ওই বাড়িতে। টানা এক মাস ওই বাড়ির আশেপাশে কেও যায়নি। ওই বাড়িতে যে সকল আত্নীয়রা যাওয়া আসা করত তাদের দেখলে গ্রামের লোকজন দূরে সরে যেত।

আমি ভাবছি, স্যার এর কি ইদুর জন্ম হয়েছে? স্যার এর ইদুর জন্ম কেন হলো? এই প্রশ্ন করতে খুব ইচ্ছা করছে, কিন্তু আবার ভয় হচ্ছে প্রচন্ড। জিজ্ঞাস করতে পারছিনা।


ইদুরটি বইয়ের নিচ থেকে এক টুকরা বোয়াল মাছের শুটকি বের করল। তারপর সেটা নাড়াচাড়া করছে। মুখ দিয়ে এদিক ওদিক ঘুড়িয়ে কি যেন দেখছে। আমি শুটকির তীব্র গন্ধ পাচ্ছি। আমি শুটকির গন্ধ সহ্য করতে পারিনা। ইদুরটি আবারো আফজাল স্যারের কন্ঠে বলল, তোর তো বোয়াল মাছ অনেক প্রিয় তাই এক টুকরো মাছ নিয়াসলাম। রাতের বেলায় সবাই ঘুমাইলে আমাকে এসব সংগ্রহ করতে হয়।

_আমি বললাম স্যার, আমি শুটকি পছন্দ করি না। গন্ধ সহ্য হয় না। বমি করব, স্যার।

ইদুরটি শুটকি মুখে করে নিয়ে চলে গেল। তারপর আবার ফিরে এল।

_ ইদুরটি আবারো স্যারের গলায় বলল, ফেলে দিয়ে আসলাম রে। তুই বোয়াল মাছ পছন্দ করতি এটা জানতাম, কিন্ত শুটকি পছন্দ করিসনা এটা জানতাম না। যখন মানুষ ছিলাম তোর বাবা বাজারে গেলে বলত আফজাল একটা ভাল বোয়াল মাছ দেখে দে তো, নিলুপ বোয়াল ছাড়া ভাত খাইতে পারে না। তোর বাবা ছিল এই গ্রামের আমার একমাত্র বন্ধু। আমি আর মাস্টারি করে কয় টাকা পেতাম। সংসার চালাইতে হিমসিম। যেকোন বড় কোন সমস্যায় তোর বাবা আমার পাশে এসে দাড়িয়েছে, কিন্তু কেও কোনদিন কিচ্ছু বুঝতে পারেনি। তোরাও পারিসনি। নীলা হওয়ার সময় তোর ম্যাডামের অনেক রক্তপাত হলো, দ্রুত হাসপাতালে না নিলে বাঁচানো যাবেনা। হাসপাতালে নেওয়ার সময় তোর বাবার সাথে দেখা। তোর, বাপ আমার কাধে হাত দিয়ে বলল এত বড় ঘটনা, আর আমাকে না জানিয়ে বেরিয়ে পরেছিস।

_চল, আমিও যাচ্ছি।

_ডক্টর বলল, সিজার করাইতে হবে এক্ষনি, না হলে রোগিকে বাচানো সম্ভবনা, সিরিয়াস প্যাশেন্ট।

সিজার করাইতে দশ হাজার টাকা জমা দিতে হবে কাউন্টারে। আমার কাছে ছিল মাত্র পনেরোশ টাকা। তোর বাপ আমার হাতের অবস্থা বুঝতে পেরে টাকাটা কাউন্টারে জমা দিয়ে বলল, তুই বউয়ের খেয়াল রাখ।


তোর ম্যাডামের একটা কন্যা হলো। চোখের মনি নীল হয়েছিল। তোর ম্যাডাম বলত নীল কন্যা। নাম রাখা হয়েছিল নীলা। নীলা হওয়ার পরে তোর বাপ হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বলল, আমার বউমার জন্য এলাকার মানুষকে মিষ্টি বিলাবি। আমি নিতে চাইলাম না।

_তোর বাপ বলল, তোকে তো একবারে দিচ্ছি না। পরে শোধ করে দিবি।

এর পরে নীলার এপেন্ডিসাইট অপারেশন এ তোর বাপ ফেরেশতার মত এসে হাসপাতালের বিল মিটিয়ে দিল। নীলার বাচার অবস্থা ছিল না। হাসপাতালে টাকা জমা না দিলে অপারেশন ও হত না। সেদিন তোর বাপকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। তার পরের বছর ই নীলা মারা গেল। অপারেশনে কি জানি ভুল হয়েছিল। নিলা যেদিন মারা গেল সেদিন তোর বাপও আমাকে জড়িয়ে ধরে কি যে কান্না, আমিও কান্না। কে কাকে শান্তনা দিবে। সেদিনটায় নীলা চিত্ত ঘোষের দই খেতে চেয়েছিল। দই এনে দেখি মেয়েটা নেই। বলেই ইদুরটি মুখ নিচু করে চি চি শুরু করল করুন সুরে। আমার মায়া লাগল।

আমি বললাম স্যার আপনি শান্ত হোন।

ইদুরটি এবার মাথা উচু করল, বলল শোন এবার তোকে আমার ইদুর হওয়ার গল্প বলি। আমি ডায়রিয়ায় মারা গেছিলাম। ছোঁয়াচে ভেবে অনেক আত্নীয়স্বজন পর্যন্ত আমাকে দেখতে আসেনি। তোর ম্যাডাম আর আমার বড় ছেলের সাথে এলাকার লোকজন কথা বলেনি। তারা ইতর প্রানীর জিবনযাপন করেছে। তোর বাপ না থাকলে আমার পরিবার জলে ভেসে যেত।

আসলে ওইটা কোন ছোঁয়াচে রোগ ছিল না। কিন্তু মানুশ স্রোতে গা ভাশাতে পছন্দ করে। মানুষ হচ্ছে স্রোতশীল প্রাণী। এদের নিজস্বতা বলতে কিছু নেই। এইযে দেখ, আজ করোনায় হাজার হাজার মানুষ মরছে। টিভিতে দেখাচ্ছে অনেক দেশেই লাশগুলোর কবর দেওয়ার জায়গা নেই। লাশগুলোকে ছুঁতে ভয় পাচ্ছে। তারপরেও এ দেশের কোটি মানুষ গায়ে গা লাগিয়ে চায়ের দোকানে চা গিলছে, শরীরে চাপ খেয়ে বাজার করছে, সীমিত আকারে ঈদের বাজারো করা হচ্ছে। অথচ কি ভয়াবহ মৃত্যুর খেলা এটা সেদিকে কারো খেয়াল নেই। এরা নিজেরাই নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে। এটা কোন শ্রেষ্ঠত্ব না। যেদিন ইদুর , গিনিপিক, তোর প্রিয় বোয়াল মাছ, শেয়াল, মানুশের হাতে মার খাওয়া কুত্তা বলবে মানুষ শ্রেষ্ঠ সেদিন মানুষ হবে শ্রেষ্ঠ। নিজেকে শ্রেষ্ঠ বললে শ্রেষ্ঠ হওয়া যায় না। মানুশের মাঝে কেও কেও শ্রেষ্ঠ।


বলতে বলতে হঠাৎ ইদুরটি গোঙাতে শুরু করল। ফোনের ভাইব্রেশন হচ্ছে। ভাইব্রেশনে ঘুম ভাংল। এটা স্বপ্ন ছিল??

No comments

আপনার মুল্যবান মন্তব্য এখানে লিখতে পারেন। ধন্যবাদ।

Theme images by Storman. Powered by Blogger.